মহারাজার দীঘি , পঞ্চগড় (Maharajar Dighi, Panchagarh)
মহারাজার দিঘী
পঞ্চগড় জেলা সদর থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে অমরখানা ইউনিয়নে অবস্থিত এক ঐতিহাসিক পুকুরের নাম মহারাজার দীঘি (Maharajar Dighi)। ধারণা করা হয়, ভিতরগড় নামের ১৫০০ বছরের প্রাচীন ঐতিহাসিক এক রাজ্যে মহারাজা পৃথু রাজত্ব করাকালীন এই দীঘিটি খনন করেন।
বিশালায়তনের স্বচ্ছ পানির এই জলাশয়ের পাড় সহ মোট আয়তন প্রায় ৮০০ x ৪০০ গজ এবং পানির গভীরতা প্রায় ৪০ ফুট। গাছগাছালিতে ঘেরা মহারাজার দীঘির চারপাশে প্রায় ১০টি ঘাট রয়েছে। কথিত আছে, পৃথু রাজা তার পরিবার পরিজন ও ধনরত্ন সাথে নিয়ে “কীচক” নামক এক নিম্নশ্রেণী দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়ে তাদের সংস্পর্শে ধর্মনাশের ভয়ে এই দীঘিতে আত্নহনন করেছিলেন।
জনশ্রুতি আছে, একসময় স্থানীয় লোকজন বিয়েশাদির অনুষ্ঠান আয়োজন করলে, আগের দিন দিঘির পাড়ে গিয়ে থালাবাসনের কথা বলে আসতে হতো। অনুষ্ঠানের জন্য দিঘির পাড়ে অদৃশ্যভাবে প্রয়োজনমতো চলে আসত থালাবাসন। ব্যবহারের পরে তা পরিষ্কার করে ফেরত দিতে হতো।
এ ছাড়া পারিবারিক বা সাংসারিক নানান সমস্যা নিয়ে দিঘির পাড়ে মানত করেও ভালো ফল পেতেন স্থানীয় লোকজন। তবে এখন সেই চিত্র না থাকলেও বিশাল দিঘির জলরাশিজুড়ে রয়েছে নয়নাভিরাম দৃশ্য। দিঘির চারপাশ সবুজ গাছের সমারোহে সারাক্ষণই পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে থাকে।
দেশের সর্বোত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরোনো মহারাজার দিঘির কথা। পঞ্চগড় জেলা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে সদর উপজেলার অমরখানা ইউনিয়নে ভারত সীমান্তঘেঁষা ভিতরগড় এলাকায় ওই মহারাজার দিঘির অবস্থান।
ইতিহাস ঘেঁটে ও জনশ্রুতি মতে জানা যায়, প্রায় ২৫ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছিল ভিতরগড় দুর্গনগরী। এটি ছিল জলেশ্বর রাজার রাজধানী। ‘কামরুপ বুরুঞ্জি’তে রাজা জলেশ্বরকে বলা হয়েছে পৃথু রাজা হিসেবে। মহারাজার দিঘি থেকে প্রায় ১৩৫ মিটার দূরে পৃথু রাজার বাড়ি ছিল বলে ধারণা করা হয়।
ভিতরগড় দুর্গনগরীর বাইরের আবেষ্টনীর উত্তরাংশ, উত্তর-পশ্চিমাংশ এবং উত্তর-পূর্বাংশ বর্তমানে ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত হওয়ায়, ধারণা করা হয় যে ষষ্ঠ শতকের শেষে কিংবা সপ্তম শতকের শুরুতে ভিতরগড় একটি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
প্রাচীন বাণিজ্য সড়ক ও নদীপথের ওপর অবস্থিত হওয়ায় ভিতরগড় এলাকার অধিবাসীরা সম্ভবত নেপাল, ভুটান, সিকিম, আসাম, কোচবিহার, তিব্বত, চীন, বিহার এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ বাংলার সঙ্গে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বজায় রেখেছিল। রাজত্ব পরিচালনার সময় ভিতরগড়ে পৃথু রাজা নির্মাণ করেছিলেন রাজপ্রাসাদ, মন্দির। খনন করান একটি বিশাল দিঘি; যা মহারাজার দিঘি নামে পরিচিত।
পরবর্তী সময়ে পৃথু রাজা কিচক নামের অসাধু ও নিম্নবর্ণের জনগোষ্ঠী দ্বারা আক্রান্ত হলে নিজ পবিত্রতা ও মর্যাদা রক্ষায় পরিবার–পরিজনসহ ওই দিঘির পানিতে আত্মহত্যা করেন। তাঁর রক্ষীবাহিনীও তাঁকে অনুসরণ করে। ফলে পৃথু রাজার রাজত্বের অবসান ঘটে।
মহারাজার দিঘির ইটবাঁধানো ১০টি ঘাট ও ঘাটের উভয় পাশে ইট ও মাটি দিয়ে নির্মিত সুউচ্চ পাড়ে সবুজ গাছগাছালি। নৈসর্গিক এক দৃশ্য।
প্রায় ২৫ বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে ঐতিহাসিক ভিতরগড় দুর্গনগরীর দৃশ্যমান স্থাপনার অধিকাংশই কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেলেও এখনো টিকে রয়েছে ঐতিহাসিক মহারাজার দিঘি। বিশাল এই দিঘি দেখতে প্রতিদিনই সেখানে হাজির হন ভ্রমণপিয়াসীরা।
সমতলের সবুজ চা–বাগানবেষ্টিত, ভারত সীমান্তঘেঁষা, কোলাহলমুক্ত, গাছগাছালির নিবিড় ছায়ায় ঘেরা ভিতরগড় দুর্গনগরীসহ মহারাজার দিঘি পর্যটকদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। বিশেষ করে প্রতিবছর শীতের মৌসুমে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় আসা পর্যটকদের বেশির ভাগই মহারাজার দৃষ্টিনন্দন দিঘিও ঘুরে যান। দিঘির পাড়ে বসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বিস্তীর্ণ জলরাশির ঢেউ আর নানান পাখির কূজনে মোহিত হন তাঁরা।
দিঘির চারপাশের সুউচ্চ প্রশস্ত পাড় দিয়ে বৃক্ষরাজির ছায়ায় হেঁটে হেঁটে পর্যটকেরা যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলেন প্রকৃতির মধে৵। কেউবা নৌকায় ঘুরে বেড়ান দিঘির পানিতে। শীতকালে দিঘির পাড়ের সবুজ গাছগাছালিতে অতিথি পাখির কলকাকলি দিঘির পাড়ে তৈরি করে মনোমুগ্ধকর পরিবেশ।
সেই সঙ্গে দিঘির সৌন্দর্য বাড়িয়েছে এর প্রবেশপথের দুই পাড়ের দুটি সিঁড়ি। প্রতিবছর পয়লা বৈশাখে দিঘির পাড়ে মেলা বসে। মেলায় ঢল নামে নানান বয়সী মানুষের।